অরুণ চন্দ্র দে::
বন্ধুত্ব এমন একটি অনুভূতি যার মাধ্যমে আমরা জীবনকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে পারি এবং আমাদের বিশ্বাস ও ভালবাসার মাধ্যমে আমরা আমাদের বন্ধুত্বকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হই, যা আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমার বন্ধু নুনুকে অর্থাৎ ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বসেই একটি গানের প্রথম লাইন মনে পড়ে গেল এবং মনে মনে গানটি আউড়াতে লাগলাম- “মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার হৃদয়ের বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে।” ১৫ই আগস্ট অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী’র ১৪তম প্রয়াণ দিবস। এই দিনটি আমার জন্য এক বিভীষিকাময় দিন। এখনও এই দিনটি এলেই যেন কাক ডাকা ভোরে দীপকের ডাক শুনতে পাই- অরুণ, নুনু (মৃদুল) নেই। এখনও আঁতকে উঠি, মনে জ্বালা হয়, দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, কারণ? কারণ আছে- আপনারা যারা ড. মৃদুল চক্রবর্তীকে জানেন এবং চিনেন সে আমার বাল্যকালের ‘হরিহর আত্মা’ বন্ধু। আমি তাকে নুনু বলেই চিনি এবং জানি। আমার এই বন্ধুটি সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। যে পরিবারে সুনামগঞ্জের রাজনীতি, সংস্কৃতি, নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনসহ এক কথায় প্রগতিশীল সব কার্যক্রমে যুক্ত। এই বাসায় সব বড় বড় রাজনীতিবিদ, বড় বড় গায়ক সুনামগঞ্জে আসলে এখানেই হতো ঠাঁই। এখান থেকেই ন্যাপ মতিয়া চৌধুরী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, মহিলা সমিতির জন্ম। এখনকার দিনে সুনামগঞ্জের স্বনামধন্য শিল্পীরা যেমন- উজির মিয়া, লতিফ মিয়া, এমরান আলী, ওস্তাদ গোপাল দত্তসহ সবার বিচরণ ছিল এই বাসায়। এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী স্বনামধন্য গীতিকার-সুরকার মনিরুজ্জামানেরও হাতেখড়ি এই বাসা থেকে। এই বাসাটির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। বাসার বড় মেয়ে রতœা দি ছিলেন তখনকার দিনে সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী। বাসার বড় ছেলে মিঠু দা ছিলেন তবলাবাদক। মাসিমা দিপালী চক্রবর্তী সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকা- নিয়ে ব্যস্ত। রন্ধনে হরি কাকা আর বাসার সার্বিক দেখাশুনার ভার নারু ভাইয়ের উপর। বাসার অন্যান্য ভাই-বোন গান বা রাজনীতির প্রতি তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। এমনকি আমার বন্ধু মৃদুল চক্রবর্তীরও তখন গানের দিকে তেমন খেয়াল বা মনোযোগ ছিল না। আমরা সব সময় খেলাধুলা, দুষ্টুমি নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। বলাবাহুল্য এই বাসাটি খেলাধুলারও সূতিকাগার ছিল। সুনামগঞ্জের সকল সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে-মেয়েরা এই বাসায়ই সমবেত হতো খেলাধুলার জন্য। যেমন- বন্দি, নান্দাই, লুকোচুরি ইত্যাদি খেলা হতো। পৌষ সংক্রান্তিতে ছন দিয়ে ভেড়াঘর বানিয়ে সারারাত সজাগ থেকে উপভোগ করতাম। এভাবেই কাটছিল আমাদের দিন। এক সময় লেগে গেল স্বাধীনতা যুদ্ধ। সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে ছোটাছুটি করছে। এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে, তারপর একদিন সীমানা পেরিয়ে ভারতে। মৃদুলরাও যথারীতি ভারতে চলে যায়। আমরাও সীমানা পেরিয়ে ভারতের বালাটে পৌঁছি। এখানে মৃদুলের সঙ্গে সুদীর্ঘ নয় মাস বিচ্ছেদ ঘটে। দেখা নেই, কথা নেই, বেঁচে আছি কিনা মরে গেছি কেউ কিছুই জানি না। দীর্ঘ নয় মাস পর দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে স্বাধীন হলো। আমরা সবাই আস্তে আস্তে দেশে ফিরে আসতে লাগলাম। মৃদুলও চলে এলো, দেখা হলো। আবারও আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলাম। ঠিক তখনই মৃদুল আমাকে বললো- আমি গান গাই, আমি গান শিখে ফেলেছি। আমি বললাম ঠিক আছে, গায়ক একটি গান শুনাও তো দেখি। তখন তার কণ্ঠে প্রথম গানটি ছিল- “আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতো কাল আমি রবো দিশেহারা, রবো দিশেহারা।” তার আবার হিন্দি গানটিও সে গেয়ে শুনালো। সেই থেকেই তার গানের জগতে যাত্রা, সে থেকেই নুনু থেকে ড. মৃদুল চক্রবর্তী হওয়ার পথে তার পদার্পণ। এক সময় মৃদুল চলে গেল সিলেটে। তারপর থেকে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের দূরত্ব বাড়তে লাগলো। একটি প্রবাদ আছে- ‘চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়’ বাস্তবিক পক্ষে তাই হলো। তারপর ঢাকা থেকে গানের উপর শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার পর পিএইচডি করে। শান্তি নিকেতন থেকে দীর্ঘদিন পর তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করে হাছন রাজা, রাধারমণসহ সকল আউল-বাউলের জীবনের উপর গবেষণা করতে করতে দেশে ফিরলো উদভ্রান্তের মতো। দেশে আসার পর মনে হলো তার উপর আধ্যাত্মিক কোনোকিছু ভর করেছে। দীর্ঘদিন এভাবে চলার পর আবার সে ঢাকায় চলে গেল। তারপর থেকেই তার উত্থান শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হয়ে গেল। মৃদুল বছরে একবার সুনামগঞ্জে আসতো তা-ও প্রতি দুর্গাপূজা অথবা বাসার কোনো অনুষ্ঠানে। পূজায় আসার আগে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলতো, নৌকা ঠিক করে রাখার জন্য। কারণ পূজায় নৌকা ভ্রমণে যেতে হবে, পূজার অষ্টমি দিনে বন্ধু-বান্ধব সহযোগে। নৌকা নিয়ে কাংলার হাওর হয়ে একদম বর্ডারে আশাউড়া বা পূজা ম-পে। সেখানে পূজা অনুষ্ঠান উপভোগ করে ফিরার পালা, নৌকা দিয়ে কাংলার হাওরের মধ্যখানে এসে নৌকা আটকিয়ে রেখে হাওরে অবস্থান। এখানে আড্ডা সমাপন করে পুনরায় গন্তব্যে রওয়ানা - এই ছিল প্রতি বছর দুর্গাপূজার আনন্দ উপভোগ। মৃদুল তেমন সংসারি ছিল না, সংসারের প্রতি সে ছিল উদাসীন। সব সময় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে কাটানোতেই ছিল তার পরম আনন্দ। এক সময়ে তার এইগুলিতে বাধা আসে। তারপর সেই সংসারের প্রতি আরো বেশি উদাসীন হয়ে যায়। জীবনে এমন কিছু কিছু পরিস্থিতি আসে যেখানে নীরব হয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার থাকে না এবং এটাই বাস্তব। মৃদুল মৃত্যুবরণ করার এক সপ্তাহ আগে আমি ঢাকায় যাই। যাওয়ার আগে ওর সাথে যোগাযোগ করে যাই। ঢাকায় পৌঁছে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমাকে বললো টিএসসিতে চলে আসতে, সে টিএসসিতে একটি অনুষ্ঠানে আছে। আমাকে টিএসসি’র প্রথম গেইটে যেতে বললো। আমিও আমার এক বন্ধুর গাড়ি নিয়ে টিএসসিতে চলে গেলাম। প্রথম গেইটে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে স্টেজ থেকে দেখে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে। আমি মৃদুল মিলে গুলশানে আমার এক বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে যাই। সেখানে ফনি দা’ও (প্রয়াত ডিআইজি ও সাবেক সচিব) উপস্থিত ছিলেন। এই দেখাই মৃদুলের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আমি চলে আসি সুনামগঞ্জ। মৃদুল জানতে চেয়েছিল- আমি সুনামগঞ্জ চলে আসছি কিনা - এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। তারপর ১৫ই আগস্ট সকাল বেলা দীপকের কণ্ঠে শুনতে পাই মৃদুলের পরপারে চলে যাওয়ার কথা। বিশ্বাস হচ্ছিল না, আর বিশ্বাস না করেই উপায় কি? জানলাম অন্তিম সংস্কার সুনামগঞ্জে হবে। সারাদিন দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে তার অন্তিম যাত্রা সুষ্ঠুভাবে সমাধানের ব্যবস্থা করলাম। রাতে তার নিথর দেহ নিয়ে লাশবাহী গাড়ি এসে বাসার সামনে থামলো। সঙ্গে তার পুত্রসম শিক্ষার্থীরা। নিথর দেহ বাসায় নিয়ে এলাম। মুখ পানে চেয়ে দেখছিলাম কি হয়ে গেল। তারপর শুদ্ধ সুচারুরূপে স্নান সমাপন করে অন্তিমযাত্রায় ছুটলাম সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাটে। আমার নিজ হাতে বন্ধুর অন্তিম কার্যক্রম সম্পন্ন করলাম আর নিজেকে সামলে নিয়ে প্রবোধ দিতে থাকলাম- সবাইকে তো এই সংসারের মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হবে। “আমিও নদীর মতো, আমিও পথের মতো মিলিয়ে যাবো, আসবো না ফিরে আর আসবো না ফিরে কোনো দিন।” আসবে না, আর কোনো দিন ফিরে আসবে না সে।
[অরুণ চন্দ্র দে, সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাট পরিচালনা কমিটি, সুনামগঞ্জ]
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
ড. মৃদুল চক্রবর্তীকে নিয়ে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি
- আপলোড সময় : ১৫-০৮-২০২৫ ০৩:১৪:৪১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৫-০৮-২০২৫ ০৩:১৬:১৯ অপরাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ